Ads Area

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি:

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি


১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত মহলে বিতর্ক রয়েছে। অনেকের ধারণা মহাবিদ্রোহ ছিল জাতীয় বিদ্রোহ। তারা মনে করেন যে, এই বিদ্রোহের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক ছিল। আবার এর বিরুদ্ধে মতের বক্তব্য হল মহাবিদ্রোহ কখনোই জাতীয় বিদ্রোহ ছিল না। তাদের যুক্তিতে এই বিদ্রোহের সঙ্গে জাতীয়তাবোধের কোন সম্পর্ক ছিল না।

    ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহ কে জাতীয় বিদ্রোহ বলেছেন, তারা কিছু যুক্তি দেখিয়েছেন। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলা চলে কিনা, এই প্রসঙ্গে আবুল কালাম আজাদ এর বক্তব্য হল যে এই বিদ্রোহকে যদি জাতীয়তাবাদের আধুনিক সংজ্ঞা দিয়ে বিচার করা হয়, তাহলে অবশ্য একে এক কথায় জাতীয় আন্দোলন বলা যাবে না। কিন্তু বিদ্রোহীদের দেশপ্রেমে কোন ঘাটতি ছিল না। তবে শুধুমাত্র দেশপ্রেম দিয়ে সমকালীন পরিস্থিতিকে কোন বিদ্রোহ ঘটানো সম্ভবপর ছিল না। তার এই বক্তব্য থেকে মনে হয় দেশ প্রেম যদি জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়, তাহলে এই বিদ্রোহকে জাতীয় আন্দোলন বলতে তার আপত্তি নেই, যদিও দেশপ্রেমকে জোরদার করার জন্য ধর্মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মোগল বাদশাহ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ, নানাসাহেব বা অন্যান্য নেতৃবর্গের বিদ্রোহে যোগদানে দেশপ্রেমের ধারণা কতদূর ছিল তা বিতরকের বিষয়।

এই অভিমতের সমর্থকদের আরেএকটি বক্তব্য হলো যে, এই বিদ্রোহে হিন্দু ও  মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে ইংরেজদের ভারত থেকে বিতাড়িত করার জন্য সঙ্গবদ্ধ হয়েছিল। ভারতের রক্ষণশীল সমাজ কখনই ব্রিটিশ শাসকদের ভারত শাসন আইন মেনে নিতে পারেনি। মুঘল শাসনের অবসানের কারণ হিসেবে মুসলিম সম্প্রদায় বিদেশি শ্বেতাঙ্গদেরই দায়ী করে। অপরদিকে বিধবা বিবাহ প্রথা প্রচলন, সতীদাহ প্রথা রদ ইত্যাদিতে শ্বেতাঙ্গ শাসনের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকায় রক্ষণশীল হিন্দুদের একাংশ ইংরেজ শাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিল। এই ঐক্যবদ্ধ জাতীয় চেতনার জন্ম দিয়েছিল। তাছাড়া কেবল সিপাহীরা নয়, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল বলে তারা এই বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহের মর্যাদাদানের পক্ষপাতী।

        মহাবিদ্রোহকে যারা জাতীয় বিদ্রোহ বলতে চাননি, তাদের যুক্তি হলো যে, এই বিদ্রোহের কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বা পরিকল্পনা ছিল না।ভারত থেকে ইংরেজ শাসন উৎখাত করার জন্য কোন সংগঠনগড়ে তোলা হয়নি। সিপাহীদের সঙ্গে ভারতের শাসকগোষ্ঠী ও বিদ্রোহের প্রধান নেতাদেরকোন যোগাযোগ ছিল না। বিদ্রোহের বিভিন্ন গোষ্ঠী বা নেতার মধ্যে কোনরকম বোঝাপড়া ছিল না। আসলে নেতার এবং বিদ্রোহের বিভিন্ন গোষ্ঠী নিজও নিজও স্বার্থেই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল, কোন বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের কথা তারা চিন্তা করেনি। কোন কোন অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সদ্ভাবের   অভাব দেখা দিয়েছিল। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে যেমন বেশ কিছু সৈনিক বিদ্রোহ করেছিল, অন্যদিকে তেমনি অনেকেই ইংরেজদের প্রতি অনুগত ছিল। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে শুধু জনগণের মধ্যেই নয়, সিপাহীদের মধ্যেও জাতীয়তাবোধের অভাব ছিল।

সমাজের সমস্ত শ্রেনীর মানুষ এই বিদ্রোহে যোগদান না করায় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহের মর্যাদা দেওয়া যায় না। দেশীয় রাজাদের মধ্যে সিনধিয়া, গায়কোয়াড, হোলকার, হায়দারবাদের নিজাম, রাজস্থান, মহীশূর ও ত্রিবাঙ্কুর এর এর রাজারাওএই বিদ্রোহ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। অন্যদিকে ঝিন্দ পাতিয়ালার শেখ দলপতিরা ইংরেজদের পক্ষে ছিল। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা এই বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল। উত্তর ভারতের এক বিস্তৃত অঞ্চল ও মধ্য ভারতের কিছু অংশে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লেও ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে বিশেষত বাংলা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে এই বিদ্রোহের প্রভাব বিশেষভাবে অনুভব করা যায়নি। সর্বভারতীয় চরিত্র না থাকায় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় আন্দোলন বলে মেনে নেওয়া যায় না।

        ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলা যায় কিনা তা নিয়ে এই পরস্পর বিরোধী মত রয়েছে। বিদ্রোহের সঙ্গে জাতীয়তাবোধের সম্পর্ক কতখানি ছিল তা বুঝতে গেলে জাতীয় আন্দোলনের স্বরূপকে বুঝতে হবে। জাতীয় আন্দোলন বলতে যদি বোঝায় যে, সমাজের প্রতিটি মানুষই এক মনপ্রাণ হয়ে একটি জীবন মরণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বে, তাহলে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কোন মতেই জাতীয় বিদ্রোহ বলা যায়না। ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার কারণেই বলেছেন ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের তথাকথিত প্রথম জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রথম নয়, জাতীয় নয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামও নয়। সুশোভন চন্দ্র সরকার, ড: মজুমদারের যুক্তির বিপক্ষের বলেছিলেন যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ যদি জাতীয় বিদ্রোহা বল হয়, তাহলে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে স্পেনের বা রাশিয়ার যুদ্ধ কেউ জাতীয় সংগ্রামের স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। ইটালির কার্বোনারী আন্দোলনেও জাতীয় আন্দোলনের মর্যাদা দাবি করতে পারে না। পক্ষে ও বিপক্ষের মত চুল পক্ষে ও বিপক্ষের মতো চুল ছেড়াচেরা বিশ্লেষণ করে নিরপেক্ষভাবে আমরা মোটামুটি এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা থাকায় একে জাতীয় বিদ্রোহ বলা এক বিতর্কিত বিষয়।

Post a Comment

0 Comments

Ads Area