সভা সমিতির যুগের বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ:
ভারতে ইংরেজি শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় ভারতীয়রা সঙ্গবদ্ধ ছিলনা। ভারতীয় শাসক শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ ভারতে উপনিবেশিক শাসনের পথ প্রশস্ত করেছিল, পলাশীর যুদ্ধ যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। মারাঠা, শিখ সবাই সংকীর্ণ স্বার্থে মারামারি, ঝগড়া-বিবাদ করেছে। রাজনীতিতে তখন সাধারণ মানুষের কোন ভূমিকা ছিল না। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাজ শাসনের অবসান হয়। দেশীয় রাজা, নবাবরা অবশ্য রইলেন। কিন্তু তারা কার্যত ব্রিটিশ রাজের ছত্রছায়ায় চলে আসেন। ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় সমাজ ব্যাপক পরিবর্তন ঘটল এবং দুটি বিশিষ্ট শ্রেণীর মানুষের উদ্ভব হল। প্রথমত, ১৭৯৩ সালে বাংলায় চিরস্থায়ী জমিদারি ব্যবস্থা প্রচলন এর ফলে এক নতুন ধরনের ভূস্বামী সম্প্রদায়ের জন্ম হলো। প্রথমদিকে জমিদার জমি হারালেন, কিন্তু সরকার তাদের পাশে ছিল। জমিদারদের যাতে আয় বাড়ে, সেদিকে সরকার নজর দিলেন। তাতে অবশ্য কৃষকদের অসুবিধা হলো। পরের দিকে আবার যখন সরকার কৃষকদের স্বার্থের কথা ভাবলেন, তখন জমিদাররা সরকারের ওপর অসন্তুষ্টি ও ক্ষুব্দ হলেন। ভারতের রাজনীতিতে জমিদার শ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। দ্বিতীয়ত, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটলে, যারা শুধু চাকরি করলে না, আইন ব্যবস্থা, সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা, চিকিৎসা ইত্যাদি বিভিন্ন গঠনমূলক পেশায় নিযুক্ত হল। তাদের মধ্যে উচ্ছ্বাসার জন্ম হলো।
এই দুই শ্রেনীর মানুষ ইংরেজ শাসনে খুশি ছিল না। কিন্তু চিন্তা ভাবনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের কোন পথ তারা তখন খুঁজে পাচ্ছিল না। ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ ছিল না। তখন তারা নিজস্ব সংগঠন গড়ে তোলার দিকে নজর দেয়। এই ভাবেই শুরু হলো সভা সমিতির যুগ।মহাবিদ্রোহের বেশ কিছুটা আগে থেকেই জমিদার শ্রেণী তাদের নিজস্ব সংগঠন গড়ে তুলেছিল। কিন্তু মহাবিদ্রোহের পরবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছিল মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সক্রিয় প্রচেষ্টায়। এই সময় ভারতের বাইরে ও কিছু কিছুপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছিল। এইসব প্রতিষ্ঠান ছিল তাদের মুখপাত্র। এই সব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেইভারতের জনমত গড়ে উঠতে থাকে। এইসব সভা-সমিতি ছিল প্রধানত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেনীর সংগঠন। স্বাভাবিক কারণেই তাই তারা এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের দাবি দাওয়া তুলে ধরেছিল। সাধারণত দরিদ্র শ্রমিক-কৃষকের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক ছিল না। এককথায়সভা-সমিতি ছিল সমাজের উপর তলার মানুষের ব্যাপার। কাজেই তাদের মধ্যে সাধারণ মানুষের আশাআকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়নি। সভা-সমিতির আরেকটিবৈশিষ্ট্য হলো এগুলি গড়ে উঠেছিল জাতি ও ধর্মের সংকীর্ণ সীমারেখা অতিক্রম করে। এইসব সভা-সমিতি গড়ে ওঠে কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ, পুনা প্রকৃতি বড় বড় শহরকে কেন্দ্র করে। যাই হোক, সভা-সমিতির প্রচেষ্টা অবশ্য খুব একটা সফল হয়নি। শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আন্দোলনের মধ্যে যে এক অবাস্তব আবেগধর্মী দিক ছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'জীবনস্মৃতি' তার সাক্ষ্য দেয়।
বঙ্গভাসা প্রকাশিকা সভাঃ ১৮২৮ খ্রিঃ রেগুলেশন অ্যাক্ট প্রবর্তন করে শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ শাসক বাংলার জমিদারদের অধিকৃত নিষ্কর জমি পুনঃগ্রনের প্রস্তাব তোলে। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাকির জমিদার কালীনাথ রায়চৌধুরী, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখের উদ্যোগে গড়ে ওঠে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা(১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে)। এর প্রথম অধিবেশন বসে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর। এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন গৌরীশংকর তর্কবাগীশ। এই সভাকেই বাংলা তথা ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ধরা হয়। এই সভার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষের মঙ্গল-অমঙ্গলকারী বিষয়গুলির আলোচনা ও পর্যালোচনা করা। কোম্পানি নিষ্কর ভূমির ওপর নেওয়া শুরু করলে এই সভা তার প্রতিবাদ করে। কোম্পানি এই করনীতির বিরুদ্ধে এই সভা একটি জনসভা আয়োজনের চেষ্টা করে। জনগণের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে সরকারি শাসন ব্যবস্থার ত্রুটি সংশোধনের জন্য এই সভা সরকারের কাছে আবেদন জানাই। যোগেশ চন্দ্র বাগল এর মতে এটি ছিল ভারতের জাতীয়তাবাদী প্রথম সংগঠন।
জমিদার সভা: উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ভারতে বেশ কিছু রাজনৈতিক সংগঠন বিকাশ লাভ করে। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের পর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে উদ্ভূত জমিদার শ্রেণী রাজনৈতিক নেতৃত্ব দানে এগিয়ে আসে। জমিদারদের উদ্যোগের ভারতের আধুনিক রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার সূচনা ঘটে। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর রাধাকান্ত দেব, দারোকা নাথ ঠাকুর ও প্রসন্নকুমার ঠাকুর এর উদ্যোগে জমিদার সভা বা ল্যান্ড হোল্ডার সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সভার সভাপতি হন রাধাকান্ত দেব এবং যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও ডাবলু সি হ্যারি। এই সভার প্রাণপুরুষ ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। এই সভার কার্যনির্বাহক সমিতির সকল সদস্য ছিলেন প্রতিষ্ঠিত জমিদার। এই সভার এক ঘোষণাপত্রে বলা হয় জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দেশীয় স্বার্থে প্রত্যকেই এই প্রতিষ্ঠান সদস্য হতে পারে।
জমিদার সভা ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি রাজনৈতিক সংগঠন। এই সভার ঘোষিত উদ্দেশ্য গুলির মধ্যে সংকীর্ণ জাতিভেদ বা আঞ্চলিকতাবাদের প্রশ্রয় ছিলনা। এই সভার প্রথম দিকে রাজনৈতিক চিন্তা ধারা ছিল যথেষ্ট উদারনৈতিক। এর প্রধান ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল জমিদার ও জমির মালিকদের সাধারণ স্বার্থ রক্ষা করা। সভার অন্যতম নেতা রাজেন্দ্রলাল মিত্র ভূমি মালিকের সাধারণ স্বার্থের পাশাপাশি রায়তের অধিকার রক্ষার কথা বলেন। তিনি এই সভার মাধ্যমে ভারতবর্ষের নিয়মতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন। জমিদারের সঙ্গে প্রজার স্বার্থ জড়িয়ে থাকায় এই সভা উভয় শ্রেণীর দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গ্রহণ করে।
বেশ কিছু বিষয়ে জমিদার সভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেই। শাসনতান্ত্রিক উপায়ে দাবি দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে এই সভা এক দৃষ্টান্ত তুলে ধরে। তাছাড়া এই সভা তাঁর আদর্শ ও লক্ষ্য প্রচারের জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় শাখা গড়ে তোলে। ফলে দেশ জুড়ে এই সংঘটিত আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই সভা ভারতীয়দের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে ইংরেজদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই সভার প্রচেষ্টার দারুন সরকার প্রতিটি গ্রামে কিছু পরিমাণ নিষ্কর জমি রাখতে রাজি হয়। জমিদারদের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে গড়ে উঠলেও এই সভায় রাজনৈতিক অধিকারের দাবি জানায়।
ভারত সভা: ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, দরকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের উদ্যোগে কলকাতার এলবার্ট হলে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বা ভারত সভার প্রতিষ্ঠাতা ঘটে। এই সংগঠনের ভারত সভা নামকরণ এর যুক্তি প্রসঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ বলেন, ইটালির মহান নেতা ম্যাৎসিনির ইয়ং ইতালির আদর্শে সমগ্র ভারতবাসীকে সঙ্ঘবদ্ধ করার লক্ষ্যে এই প্রতিষ্ঠান নামকরণ করা হয় ভারত সভা। এই সভার বেশিরভাগ সদস্য হয়েছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ভারত সভার প্রাণপুরুষ ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আনন্দমোহন বসু।
ভারত সভার লক্ষ্য ছিল দেশজুড়ে ব্রিটিশবিরোধী জনমত গড়ে তোলা, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতির সম্পর্ক তৈরি করা, সর্বোপরি রাজনৈতিক আন্দোলন গুলি গেম জনগণকে শামিল করানো। এই সমস্ত উদ্দেশ্য গুলি পূরণ করার জন্য বাংলার মফসসল জুড়ে ভারত সভার প্রায় ১২৪টি শাখা গড়ে ওঠে। ভারত সভার উদ্দেশ্য গুলি পূরণ করার জন্য সুরেন্দ্রনাথ বাংলা ছেড়ে সর্বভারতীয় প্রচারে বের হন। তার উদ্যোগে বাংলার বাইরে লখনও, মিরাট, লাহোর, আমেদাবাদ, মাদ্রাজ প্রভৃতি স্থানে ভারত সভা কবে গড়ে ওঠে।
ভারত সভা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা, মাতৃভাষা সংবাদ আইন, অস্ত্র আইন, ইলবার্ট বিল সহ একাধিক বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে। লিটন এর আমলে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার্থীদের বয়স ২১ থেকে কমে ১৯ করা হয়। সুরেন্দ্রনাথ এর নেতৃত্বে ভারত সভা এর প্রতিবাদ জানাই। এই শহরে তরফে ইংল্যান্ড ও ভারতের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা গ্রহণ ও পরীক্ষার্থীদের বয়স ২২ করার দাবি তোলা হয়। ইংরেজ সরকার ভারতীয়দের এই দাবির অনেকটাই মেনে নেয়।
বড়োলাট লিটন এর আমলে মাতৃভাষা সংবাদপত্র আইন( ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দ) পাস করানো হয়। ইতিপূর্বে ক্যানিং এর আমলে পরবর্তী অস্ত্র আইনকে বড়োলাট লিটন কঠোরভাবে বলবৎ করেন। মাতৃভাষা সংবাদপত্র আইন এর মাধ্যমে দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা গুলির উপর নানা ধরনের বিধি-নিষেধ চাপানো হয়। অন্যদিকে অস্ত্র আইন দ্বারা ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি ছাড়া ভারতীয়দের আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অধিকার নিষিদ্ধ হয়। ভারত সভা এই দুটি কালা আইন এর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলে। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এর সভাপতিত্বে কলকাতার টাউন হল এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। শেষ পর্যন্ত বড়োলাট রিপন এর আমলে মাতৃভাষা সংবাদপত্র আইন সংশোধন করে নেওয়া হয়।
বড়োলাট রিপন এর আমলে তার আইন সচিব কোর্টনি ইলবার্ট একটি বিল তৈরি করেন। এই বিলের মাধ্যমে ইউরোপীয় ও ভারতীয় বিচারকদের সমমর্যাদা ও সক্ষমতার অধিকার দান করা হয়। ইতিপূর্বে কোন ভারতীয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়রা জজ এর ইংরেজ আসামিদের বিচার করার অধিকার না থাকলেও এই ইলবার্ট বিলে সেই অধিকার দেওয়া হয়। তাই এই বিল ইউরোপীয়দের মর্যাদায় প্রবল আঘাত হানে এবং তারা এর তীব্র বিরোধিতা করে। কলকাতা হাইকোর্টের ব্যারিস্টার ব্রানসন এর নেতৃত্বে ইংরেজরা ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করে এবং এই বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ইউরোপীয়দের এই আন্দোলনের প্রতুত্তরে ভারত সভা প্রতি আন্দোলন করে তোলে। যদিও শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ইউরোপীয়দের দাবি মেনে এ নিয়ে এই বিলের বেশকিছু ধারা সংশোধন করে। ভারত সভার আন্দোলন ব্যর্থ হলেও তাদের আন্দোলনের জেরে জনমানসে ইংরেজ ও ভারতীয়দের মধ্যে জাতি বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে।
হিন্দু মেলা: রাজনারায়ণ বসু, নবগোপাল মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের উদ্যোগের হিন্দুমেলা নামে এক বার্ষিক অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটে। নবগোপাল মিত্র ছিলেন হিন্দু মেলার প্রধান উদ্যোক্তা। প্রথমে দিকে হিন্দু মেলার সম্পাদক ছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর নবগোপাল মিত্র ছিলেন সহকারী সম্পাদক। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দুমেলা প্রসেনজিৎ তার বাক্যকথার উল্লেখ করেন- ''কলিকাতার প্রান্তবর্তী কোন একটি উদ্যানে বৎসরে তিন-চারদিন ধরে এই মেলা চলত। সেখানে দেশি জিনিসের প্রদর্শনী, জাতীয় সংগীত, বক্তৃতাদি বিভিন্ন উপায়ে লোকের দেশানুরাগ উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করত।''
ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার হিন্দু মেলার উদ্দেশ্য ছিল বলে উল্লেখ করেন। এগুলি হল জাতীয়ভাবের প্রসার ঘটানো, দেশাত্মবোধ সৃষ্টি করা এবং হিন্দুদের মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতার মনোভাব গঠন করা। হিন্দু মেলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- '' আমাদের এই মিলন সাধারণত ধর্ম-কর্মের জন্য নহে, কোন বিষয় সুখের জন্য নহে, কোন আমোদপ্রমোদের জন্য নহে, ইহা স্বদেশের জন্য, ইহা ভারতভুভির জন্য।'' 'যোগেশচন্দ্র বাগল হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত' রচনা মেলার প্রথম অধিবেশনের এক বিবরণ দিয়েছেন। এ বিবরণ থেকে জানা যায়, হিন্দু মেলার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ৬টি কমিটি গঠিত হয়। প্রথম কমিটির কাজ ছিল হিন্দুদের মধ্যে বিদ্বেষ ভাব দূর করে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। দ্বিতীয় কমিটির কাজ ছিল এক বছরে হিন্দু সমাজে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের বিবরণ তৈরি করা। তৃতীয় কমিটির কাজ ছিল দেশীয় বিদ্যা শিক্ষার উন্নতি ও প্রসারে নিয়োজিত স্বদেশীদের সম্মান জানানো। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ কমিটি গুলির কাজ ছিল দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শিল্পজাত পণ্য সংগ্রহ করে সেগুলি মেলায় প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা।
হিন্দু মেলা তার জাতীয়তার আদর্শ ও উদ্দেশ্য গুলিকে যৌন সক্ষম এর প্রচার করার জন্য 'ন্যাশনাল পেপার' নামে এক পত্রিকা প্রকাশ করে। এর ছাপানোর নাম দেওয়া হয় 'ন্যাশনাল প্রেস'। এছাড়াও একটি ন্যাশনাল স্কুল, একটি ন্যাশনাল জিমনেসিয়াম গড়ে তোলা হয়। হিন্দু মেলা উপলক্ষে কিছু সুন্দর গান রচিত হয়। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত '' মিলে সব ভারত সন্তান এক তান মন প্রাণ, গাও ভারতের যশোগান'', মনোমোহন বসু রচিত '' দিনের দিন সবে দিন ভারত হয়ে পরাধীন'' এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত '' লজ্জায় ভারত যশো গাহিব কিরে'' ইত্যাদি গানগুলি স্বদেশী ভাবনার প্রসারে সাহায্য করে। হিন্দুমেলা বাঙালির মনে ঐক্য ও স্বনির্ভরতার বীজ বপনের সক্ষম হয়। স্বদেশবাসীর অন্তরে স্বজাত্যবোধ ও স্বাবলম্বন বৃত্তির উনমেসে এই মেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তাই গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে বলেন '' হিন্দুমেলা হল খাটি স্বদেশী মেলা''।